অর্থনীতিতে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান বাড়ছে মনে হচ্ছে

ওয়ার্ল্ড  পোল্ট্রি সায়েন্স এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ শাখা (ওয়াপসা-বিধি) কর্তৃক আয়োজিত দশম আন্তর্জাতিক পোল্ট্রি শো ও সেমিনার উদ্বোধনী ভাষণে কৃষিমন্ত্রী বলেছিলেন স্বাস্থ্যবান ও উন্নত দেশ গড়তে হলে ২০২১ সালের মধ্যে ডিম ও  মুরগির মাংস উৎপাদন দ্বিগুণ করতে হবে।

এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী খুবই আন্তরিক যার সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে বার্ডফ্লুর মতো প্রকোট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছিল। এই নির্দেশনার পথ ধরে দেশে বর্তমানে ছোট-বড় ৭০ হাজার পোল্ট্রি খামার গ্রামীণ ও নগর অর্থনীতিতে কাজ করে চলছে নিরন্তর গতিতে।

বিপিআইসিসির সূত্র মতে দেশের পোল্ট্রি খামারগুলোর প্রতি সপ্তাহে একদিনের লেয়ার, ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির বাচ্চা ৯৫ লাখ থেকে ১ দশমিক ১০ কোটি উৎপাদিত হচ্ছে এবং বাচ্চা উৎপাদনের স্বয়ংসম্পূর্ণতার কারণে বিগত কয়েক বছর ধরে ১৮ থেকে ২২ শতাংশ হারে ডিম ও মুরগির উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে অর্থাৎ ২০১৬ সালে মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন ছিল যেখানে ৯০ লাখ; দুই বছর পর তা দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ যার মধ্যে লেয়ার ও ব্রয়লার উৎপাদন করছে ব্যক্তিগত মালিকানাধীন খামারি এবং সোনালি বাচ্চা উৎপাদন করছে সরকারী মালিকানাধীন পোল্ট্রি খামারগুলো।

তথ্য মতে সারাদেশের পোল্ট্রি খামারগুলোতে ২০১৬ সালে যেখানে দৈনিক ১৫১০ টন মুরগির মাংস উৎপাদন হতো দুই বছর পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮৫১ টনে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ মুরগির মাংসের দৈনিক উৎপাদন ৩৩০০ টনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। আবার ডিম উৎপাদনেও দেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে যেমন ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে যেখানে ডিমের উৎপাদন ছিল ১০১৭ কোটি পিস যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দাঁড়ায় ১৯৯১ কোটি পিস। কিন্তু বর্তমানে ডিম এবং মাংসের চাহিদার তুলনায় সরবরাহ অপ্রতুল ফলে তার প্রভাব ভোগের উপর পতিত হয় যেমন প্রতিজনে বছরে ডিম খাওয়া উচিত ১০৪টি সেখানে মাত্র ৫০টি ডিম মাথাাপিছ প্রপ্তি হচ্ছে যা উন্নয়ন বিশেষত ১০০ তে উন্নীত করতে হলে ব্যাপক কর্মসূচীর প্রয়োজন। কারণ আমাদের মোট খাদ্য সরবরাহের ১০ দশমিক ৩১ শতাংশ আসে পোল্ট্রি থেকে মাংস ও ডিম আকারে।

আবার মুরগির মাংসের বার্ষিক ভোগ ৪ দশমিক ২ কেজি থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ কেজিতে উন্নীত করতে ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ জরুরী। বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি)-এর ১৭টি লক্ষ্যের মধ্যে ৭টির সঙ্গে পোল্ট্রি শিল্পের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বিধায় আলাদাভাবে এই শিল্পের গুরুত্ব অনায়াসেই চলে আসে। কারণ বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির উপখাত হিসাবে পোল্ট্রি খাতের অবদান ২ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষের স্ব-নিয়োজিত কর্মসংস্থান প্রত্যক্ষভাবে এই খাতে রয়েছে।

যদি পরোক্ষ অংশটি যোগ করা হয় তবে এই অংকটি দাঁড়ায় প্রায় ৮০ লাখ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৮ বলছে মানুষের প্রাণিজ আমিষ চাহিদার ৪৫ শতাংশ এখন পোল্ট্রি খাত নির্ভর এবং বিনিয়োগ হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা যেখানে আত্মকর্মসংস্থান তথা উৎপাদন আয় বাড়ানোর অপূর্ব সুযোগ রয়েছে। পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে সংযুক্ত সংগঠনের নেতারা মনে করেন দেশে প্রতিবছর গড়ে ১৫ লাখ জনশক্তি শ্রমবাজারে যোগ হচ্ছে। আবার শিল্পায়ন ও নগরায়নের কারণে ১ শতাংশ হারে কমছে আবাদি জমি যা এক বিস্ময়কর চিত্র।

এই পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতের খাদ্য নিরাপত্তা তথা পুষ্টি নিরাপত্তায় এক জ্বলন্ত ভূমিকা রাখতে পারে এই খাতটি। খাদ্য কৃষি ও বিশ্ব স্বাস্থ্য গাইড লাইন অনুযায়ী মানব দেহের শক্তির ৬০ শতাংশ আসবে শস্য জাতীয় পণ্য থেকে, ১৫ শতাংশ আসবে আমিষ জাতীয় খাদ্য থেকে এবং এই আমিষের ২০ শতাংশ হবে প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাছ, মাংস ও ডিম থেকে। বর্তমানে বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ১ জন মানুষ ৭ গ্রাম ডিম এবং ১৪ গ্রাম মুরগির মাংস খেয়ে থাকে যা থেকে আমিষ আসে যথাক্রমে ১ ও ৩ গ্রাম অথচ এই সংখ্যাটি হওয়ার কথা কমপক্ষে ১৫ গ্রাম। একটি প্রবাদ আছে ‘সুস্থ খাবার সুস্থ জাতি’ এবং এর জন্য প্রয়োজন  পোল্ট্রি উৎপাদনে জীবাণুমুক্ত ব্যবস্থাপনা।

এক সময় এই শিল্পটি ছিল আমদানিনির্ভর কিন্তু বর্তমান বাজারে ক্রমাগত চাহিদার কারণে ইহা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পোল্ট্রি খাদ্যের প্রায় ৯৫ শতাংশই আধুনিক ফিড মিলগুলোতে উৎপন্ন হচ্ছে এবং এই খাদ্যে ব্যবহৃত ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হচ্ছে। এই পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের ৪০ ভাগই নারী যা নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরেই গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে। দেশের আধুনিক হ্যাচারিগুলোতে যান্ত্রিক উপায়ে প্রতি সপ্তাহে ১ দশমিক ১০ কোটি ডিম ফোটানো হয় এবং এই শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি হয় বায়োগ্যাস, বিদ্যুত ও সার।

বাংলাদেশে সর্বাধুনিক পদ্ধতিতে  মুরগির মাংস প্রক্রিয়াজাত করা হয় যা ঢাকা শহরের বিভিন্ন পাঁচতারা হোটলসহ শপিংমলগুলোতে সরবরাহ করা হয়। এই ব্যাপারে দাতা সংস্থা কিংবা সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আগামী বিশ সালের মধ্যে ওই খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা পঞ্চাশ হাজার কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা ১ কোটি জনশক্তির হবে বলে আশা করা যায়। কারণ এই খাতে ব্যবসা আরও পাঁচটি ব্যবসার মতো নয় এবং গ্রামাঞ্চলে অগণিত খামারি সনাতনী কায়দায় খামার পরিচালনা করে থাকে যেখান থেকে ডিম কিংবা মাংস সরবরাহ একটি স্পর্শ কাতর বিষয়।

পুষ্টির মান বজায় রেখে অনায়সেই পোল্ট্রি বাজার রফতানিমুখী করা যায় বিশেষত মধ্য প্রাচ্যে যেখানে ষাট লাখ বাংলাদেশী রয়েছে যাদের কাছে দেশীয় মাংস ও ডিম খুব প্রিয়। কিন্তু এই ব্যবসায় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ অন্যান্য ব্যবসার আদলে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে যার রোগ বালাই, আপদকালীন সময়ের জন্য প্রণোদনা, কর মওকুফ সুবিধা, কাঁচামাল ও পণ্য আমদানিতে শুল্ক অব্যাহতি, নীতি সহায়তার অনুপস্থিতিতে, এ্যাডভান্স আয় কর, পোল্ট্রি খাতকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের মর্যাদা না দেয়া ওষুধের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ডিডিজিএসের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বলবত, ঋণের ক্ষেত্রে বর্ধিত হারে সুদের হার ইত্যাদি। তাই পোল্ট্রি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে সরকারের প্রাণিসম্পদ নীতিমালার বাস্তবায়ন অর্জনের লক্ষ্যে উপরোল্লিখত চ্যালেঞ্জসমূহের প্রাণিসম্পদের প্রচলিত খাত/উপখাতসমূহ যেমন মুরগির খামার স্থাপন, পশুখাদ্য, টিকা, ওষুধপত্র ক্রয় ইত্যাদিতে ঋণ প্রদান করতে হবে স্বল্প সুদে।

বর্তমানে পোল্ট্রি কৃষির উপখাত হলেও ঋণ নিতে হয় শতকরা ১৬ টাকা হারে অথচ কৃষি খাতে ঋণের সুদ মাত্র ৫ শতাংশ। একটি বিশ্লেষণে দেখা যায় যে প্রতিটি পোল্ট্রি ফার্মের ৬৫ শতাংশ খরচ হয় ফিডে যার মূল উপাদান ভুট্টা যার উৎপাদন খরচ কমাতে পারলে অনায়াসেই ডিম/মাংসের দাম কমে আসবে। কারণ ভুট্টার প্রায় ৪০ শতাংশ দেশীয় খামারে উৎপাদিত হয়। দেশে অন্যান্য কৃষি পণ্যের জন্য হিমাগারের ব্যবস্থা করেছে বিশেষত আলু, দুধ, মাছ ইত্যাদি কিন্তু ডিম কিংবা মাংসের জন্য তেমন কোন ব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয় না।

সরকার পোল্ট্রিকে শিল্প হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে ফলে প্রতিটি খামারের নিবন্ধন জরুরী যা প্রশাসনিক কাজে সহায়তা করবে। দেশে সম্প্রতি প্রাণিসম্পদের মেলা শুরু হয়েছে যা প্রশংসনীয় এবং এই মেলাতে পোল্ট্রি শিল্পকে আলাদাভাবে মর্যাদা দিতে হবে। এই দিকগুলো বিবেচনায় রেখে যদি পোলট্রি শিল্পকে সংগঠিত করা যায় এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় তা হলে দেশ পোল্ট্রি শিল্পে একদিন স্বয়ং সম্পূর্ণ হবে।