ছোট গল্প : প্রিয়তমার উপহার

প্রিয়তমার উপহার
(গল্পটি কাল্পনিক, কারো জীবনের সাথে মিলে গেলে আন্তরিকভাবে দুখিত)

ঢাকা কলেজে রাজন যখন ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্র তখন নাজমা ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। কোন এক সুত্র ধরে দু জনের মধ্যে পরিচয় ও গুড রিলেশন তৈরী হয়। রাজন নাজমাকে আন্টি বলে ডাকে। নাজমার গ্রামের বাড়ী ছিল খুলনায় আর খুলনার আকরাম মোল্যার সাথে তার বিবাহ হয়। রাজন বাগেরহাটের সরকারী পিসি কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ায় খুলনায় নাজমার বাড়ীতে আসা যাওয়া করে। নাজমার স্বামী ভদ্র লোক বিল্ডিং কন্সট্রাকশনের প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার। বেশীর ভাগ সময়ে বাইরে বাইরে থাকেন। একমাত্র মেয়ে কেয়াকে নিয়ে মফস্বলের এ বাড়ীতে থাকতে নাজমার তেমন ভাল লাগে না। কেয়া চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী। দুষ্টুমী করে, ও নাজমার কাছে পড়তে চায় না। এ বাড়ীতে তাই কেয়ার টিচার হিসাবে আগমন ঘটে তামান্নার। তামান্না মাষ্টার্স শেষ পর্ব পরীক্ষা দিয়ে নিরিবিলি হয়ে পরীক্ষার ফলাফল এর জন্য পথ চেয়ে আছে। সারা বৎসর ছাত্র গ্যাঞ্জামে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ থাকলেও রেজাল্ট দিতে কখনো তিন মাসের বেশী দেরী করে নাই। অথচ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষার ডেট চেঞ্জ করে করে প্রতি বৎসর পরীক্ষা হলেও রিজাল্ট দিতে মাত্র দেড় বছর সময় লাগছে। এই সব নানা ভাবনা এখন তামান্নার মাথায়।

নাজমা বাসায় নেই। পাশের বাসায় গেছে বেড়াতে। আন্টি আন্টি বলে ডাকতে ডাকতে রাজন ঘরের ভিতরে ঢুকে গেল। রাজন আগে যেমন ঢুকত আজও তেমনি ভঙ্গিতে ঢুকে পড়েছে হাতে একটা গোলাপ। রাজন মাঝে মাঝে কেয়ার জন্য গোলাপ রজনী গন্ধা কিনে নিয়ে আসে। আজ নিয়ে এসেছে গোলাপ। নাজমার ঘরে নাজমাকে না পেয়ে কেয়ার পড়ার ঘরে ঢুকে পড়ে। কেয়া পড়া রেখে ভাইয়া বলে রাজনকে জড়িয়ে ধরল। হাতের গোলাপটি কেড়ে নিতে যাচ্ছে। কিন্তু রাজন আজ সহজে কেয়াকে গোলাপটি দিচ্ছে না। গোলাপ নিয়ে কেয়া ও রাজনের জড়াজড়ি দেখে তামান্না কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছে। হঠাৎ রাজন তামান্নার হাতের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বলছে, গোলাপটা আপনাকে দিলাম, আপনি নিন। আপনার জন্য এনেছি আজ।

তামান্না কথারও কাজের প্রতিত্তোরে গোলাপটি ধরে বলছে আপনাকে ধন্যবাদ। তামান্নার কথা শুনে কেয়া নিরব হয়ে গেল। আর কেয়ার এ নিরবতার জন্য তামান্না ও রাজন দুজনই লজ্জা পেল। তামান্নার মাথা নিচু হয়ে গেল লজ্জাতে। হঠাৎ কি কাজটা হয়ে গেল? যা তামান্না কখনো কল্পনায়েও ভেবে দেখেনি। তামান্না এখন কি করবে ? কি বলবে? ফুলটি কেয়ার দিকে এগিয়ে বলল-
কেয়া গোলাপটি ধর, তোমার ভাইয়া তোমার জন্যই এনেছে।
না আপা। আমার জন্য আনলেতো আমার কাছে দিত। ভাইয়া নিশ্চয় আপনার জন্য এনেছে। তা না হলে আপনার হাতে দিবে কেন? ভাইয়া আপনি আপার জন্য এনেছেন না?
কেয়া গোলাপটি আজ তোমার আপার জন্য এনেছি।
আপনি আমার জন্য গোলাপ আনতে যাবেন কেন? আর আপনার সাথে আমার কিসের সম্পর্ক?
মনে কিছু করবেন না। আপনি যে সম্পর্ক ধরবেন পরম করুনাময় হয়তঃ তার রহমত থেকে সেই সম্পর্কই স্থাপন করবে। ফুল পবিত্র স্বর্গ হতে এসেছে। আর সেই ফুল কখনো খারাপ সম্পর্ক আনে না।
ও ধস ঝড়ৎৎু… কেয়া, আমি উঠছি। তোমার আম্মা এলে বল।
কোথায় উঠছো তামান্না? দ্রুত বেগে নাজমা ঘরে ঢুকল।
আরে রাজন কখন এসেছ? আমি বাবা একটু পাশের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। অনেক দিন যাব যাব করছিলাম বটে, সময় করে যেতে পারি না। আজ সময় পেলাম তাই। তাই তুমি দাড়িয়ে কেন? রাজন বসো বসো। কেয়া তোমার আপাকে চা দিয়েছ?
খালাম্মা আমি আজ কিছু খাব না।
তোমাকেতো বেশী কিছু খেতে দিচ্ছি না। পাশের বাসায় ঐ আপারা আসলেন তাদের জন্য চা করলাম ভাবলাম তামান্নার জন্য একটু রেখে দিই। যাও ফ্লাক্সটা ধরে নিয়ে এসো। তোমার আপা আর তোমার ভাইয়া খাবে।
কেয়া পাশের রুমে গেল ফ্লাক্সটা আনতে তামান্না চুপ। মাথা নিচু করে রইল। কি বলবে কিছু ভেবে পাচ্ছে না। রাজন তামান্নার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভাবছে তামান্না খুব সুন্দরী! তামান্না যাবার পর আন্টির কাছে জানতে হবে ওর ব্যাপারে সব কিছু। নাজমা পিরিচে করে নাস্তা এগিয়ে দিয়ে ফ্লাক্স থেকে চা ঢেলে দু’জনকে খেতে দেয়। কিন্তু তামান্নাকে নিরব দেখে রাজনও নিরব রয়েছে।
তামান্না যদি খায় তবেই রাজন খাবে, নইলে রাজন খাবে না। এ আবার কেমন জেদ মনে মনে ভাবছে তামান্না। তার সাথে তামান্না কিসের সম্পর্ক যে তার সাথে রাজন…জেদ ধরছে। তারপর তামান্না এক খানা বিস্কিট নিল। চা-এ মুখ দিতেই চেয়ে দেখল অপলক দৃষ্টিতে রাজন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আবারও লজ্জ্বা পেল। লজ্জ্বাবনতয় একটা মৃদু হাসী দিয়ে তামান্না চা এর পেয়ালা রেখে চলে গেল। তামান্নার যাবার ছন্দটা হল, এটা সিনেমার নায়িকা শাবনুর, মৌসুমী ও পপির রোমান্টিক পথ চলার ষ্টাইল। রাজন এক ভাবে তাকিয়ে তামান্নার যাওয়াটা দেখল। রাজনের এসব তাকাতাকী নাজমার চোখ এড়াতে পারেনি। নাজমা কোন সংকোচ না করে বলে ফেলল। রাজন তুমি কি তামান্নার প্রেমে পড়ে গেলে? তোমাদের চাল চলন ও আচারনে সেটা প্রমান করছে। রাজন মনের ভিতর কোন কথা চেপে না রেখে নাজমাকে বলল…
আন্টি, তামান্নাকে আমার এক পলকেই ভাল লেগে গেছে। আপনি ওর বিষয়ে খোজ নিন। আমি ওর সাথে বন্ধুত্ব মানে ফ্রেন্ডসিপ করিতে চাই।

রাজন আবার নাছড় বান্দা মুখে যা বলে তাই করেই ছাড়ে, নাজমা এটা জানে। এখন নাজমা কি করবে? কয়েক দিন হল তামান্না এ বাড়ীতে আসা যাওয়া করছে। তার মধ্যে এত কিছু বলা কি সম্ভব? তারপর তারওতো একটা মন বলে কিছু আছে। শুধু এক জনের ভাল লাগা বা পছন্দ দিয়ে তো কোন কাজ হয় না। উভয়ের সম্মতির দরকার আছে। মনের ব্যাপার আছে। তাই আস্তে আস্তে পা বাড়াতে হবে। হুট করে কোন কিছু হয় না।

পরপর দু’দিন হল তামান্না আর আসছে না কেয়াকে পড়াতে। নাজমা চিন্তায় পড়ে গেলে। ও ভাবল তামান্না আর নাও আসতে পারে। পরদিন তামান্না এল কেয়াকে পড়াতে। না আসার কারন জানতে চাইল। তামান্না বলল একটা বিশেষ কাজে ওর এক খালার বাসায় যেতে হয়েছিল বলে আসতে পারিনি। পরে আবার যেতে হবে। তবে কবে কখন যাবে তার কোন দিন তারিখ জানা নেই। এভাবে কয়েক দিন কেয়াকে পড়ানো বন্ধ রেখে আবার পড়ানো শুরু করলো। তামান্না আসে কেয়াকে পড়ায়। রাজন এর সাথে দেখা হয়, কথা হয়, কিছুটা হাসি ঠাট্ঠার সাথে গল্পও করে। সুযোগ বুঝে একদিন তামান্নাকে জানাল রাজন তার সাথে বন্ধুত্ব করতে চায়। অং ধ ঋৎরবহফ ংযরঢ়…
তামান্নাও মনে মনে এটা চেয়েছিল।

সেদিন ফুল দেবার পর থেকে তামান্নারও রাজনকে খুব ভাল লেগেছে। তামান্না শুধু রাজনকে এতটুকু বলল আপনার এ ব্যাপারটা কেয়ার আম্মা জানে কিনা? এতে রাজন জানাল জানে না। তামান্না মনে মনে খুুশী হল। তামান্নার স্বভাব দেখে রাজন বুঝতে পারল তার রিজাল্ট না সুচক। তাই নাজমাকে সতর্ক করে দিল। এ বিষয়ে আর কোন কথা না বলার জন্য। রাজন প্রতিদিন আসতে লাগল কেয়াকে নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরতেও যায়। আবার কখনো নাজমাকেও সাথে নিয়ে যায়। এভাবে একদিন নাজমা তামান্নাকে সাথে নিয়ে ঘুরতে নদীর ওপার সেনহাটি গেল, রাজন সাথে রয়েছে। তামান্না যেটা মনে মনে চায়। ওদের ঘুরতে ঘুরতে ক্লান্তি এসে গেল। কেয়া, বায়না ধরল আইসক্রিম খাবে। ওদিকে তামান্নার ও গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কোন পানীয় তার খেতে হবে। কোথাও কোন যানবাহন পাচ্ছেনা খুজে, যে সবাই তাতে উঠে যাবে। কিছুক্ষণ পথ পানে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ একটি রিক্সার আবির্ভাব ঘটল। তাতে চার জন যাওয়া সম্ভব নয়। নাজমা অতি সুচতুর এক বুদ্ধি খাটাল ও বলল আমি যাবনা তামান্না তোমরা যাও। তামান্না রাজনের সাথে যাবে মনে মনে আসা করে। কিন্তু পাছে লোকে কিছু বলে ভেবে যেতে পারছে না। তখন নাজমা বলছে-তুমি যাও তামান্না।
যা হোক কৌশলে হলেও তামান্নার ইচ্ছাটা পূরণ হলো। পাশাপাশি রিক্সায় বসাতে তামান্নার শরীরে কেমন যেন একটা শিহরন আন্দোলিত হতে লাগল। কারন মনে যাকে কল্পনা করছে আজ তার সেই কল্পনা-স্বপ্ন বাস্তব রুপ নিয়েছে। মনে মনে দুজনের চোখে চোখ পড়ছে মাঝে কেয়া বসে আছে। এভাবে দুজনের সম্পর্ক শুরু হলো এবং ক্রমে ক্রমে ঘনিষ্ট থেকে ঘনিষ্টতর হতে লাগল।

বেশ কিছু দিন যাওয়ার পর এক পর্যায়ে তামান্না নাজমাকে বলে ফেলল। রাজনের সাথে ঘোরা যায় কথা বলা যায়। রাজনের ভাল একটা মন আছে যে মনের সাথে মন মিশিয়ে এক হওয়া যায়। তামান্নার কথা শুনে নাজমা বলল-তুমি দেখি আমার ছেলেটার প্রেমে পড়ে গেছ। তা ভাল ভাল। রাজন খুব ভাল ছেলে আমি ওকে ৮/১০ বছর ধরে জানছি।
খালাম্মা, কিন্তু ভয় হয়।
কিসের ভয় তামান্না?
ভালবাসার সুখ ক্ষনিকের কিন্তু বেদনা চিরদিনের, ভালবাসা কাছে টানার চেয়ে দুরে ঠেলে দেয় বেশী।
তামান্না এতো ভয় পেয়ো না। বিধাতা বলে একটা জিনিস আছে।

এভাবে চলছে ওদের প্রেম ভালবাসা। দুজন দুর থেকে ভালবেসে যাচ্ছে। কাছে এলে দুজন কিছু বলতে পারে না। মনের কথা মনেই রয়ে যাচ্ছে বলতে পারছে না। রাজন দেখল এভাবে চলে না। যাকে ভালবাসি, যার ভালাবাসা পেতে যাচ্ছি, তাকে জানাতে হবে, আপন করে পেতে হবে।

সাত পাঁচ অনেক ভেবে একদিন নাজমার সামনেই তামান্নাকে বিয়ের অফার করে রাজন। তামান্নার ভয়ে গলাটা কাঠ হয়ে আসে, কিছু বলতে পারে না। তামান্না কিন্তু মনে মনে এমনটি আশা করছিল। আর হলো তাই। কিভাবে এ কথার পর প্রিয়কে আলিঙ্গন দিবে, তাই মাথা নিচু করে পাশের ঘরে চলে গেল এবং এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে রাজনের হাতে দিল। নাজমা ব্যাপারটা বুঝতে পারল না কি ঘটনাটি ঘটল। এ দিন তামান্না রাজনকে কোন উত্তর করল না।
অবশেষে নাজমা দু জনের সাথে আলাদা আলাদা ভাবে কথা বলে মধ্যস্থতা করে উভয়ের বিয়ের দিন ধার্য করে ফেলে। সামনে ফাল্গুন মাসের ১৫ তারিখ বিয়ে দিন। বিয়ে ঢাকায় যেয়ে হবে। রাজনের পক্ষে সব ব্যবস্থা করবে রাজন নিজে। আর তামান্নার পক্ষে সব কাজ করবে নাজমা।

রাজন এ ঘটনাটি একটি চিঠিতে জানাল বাড়ীতে। পিতা-মাতা অনেক আগেই মারা গেছে। বাড়ীতে আছে দুইবোন জেবিন ও মেহজাবিন। পিতার প্রায় তিনশত বিঘা সম্পত্তি চাচা দেখা-শুনা করে। রাজন কখনো চাচার উপর কথা বলে না। যেহেতু ওর চাচা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সম্মানিত ব্যক্তি। চাচা নাজিমুদ্দিন রাজনের চেয়ে জেবিন ও মেহজাবিনকে একটু বেশী ভাল বাসে। কারন নিঃসন্তান ব্যক্তির পাশে ছায়া হয়ে ওরা দুই বোন মিশে আছে। ওরা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিতা। পোশাক আশাকে মনে হয়ে বিলেতি নয় আমিরিকান। প্যান্ট-গেঞ্জি,স্কাট, কোট পরে চলে। অর্থাৎ যাহা ইচ্ছে তাহাই করে, শাসন করার মত ওদের কেহ নেই। চিঠিতে রাজনের বিয়ের সংবাদ শুনে জেবিন রাগে একে বারে লাল। চাচা নাজিমুদ্দিন ও এ বিয়েটা চায় না। কারন এ বাড়ীর সবাই জানে রাজনের সাথে বিয়ে হবে জেবিনের এক বন্ধুর বোন ঝুপুরের। ঝুপুর এ বাড়ীতে আশা যাওয়া করছে প্রায় ৪/৫ বছর ধরে। এখন ঝুপুরকে বাদ দিয়া এ বাড়ীর পক্ষে অন্য মেয়েকে বধুবরণ করা কখনো সম্ভব নয়। এতে নাজিমুদ্দিন সাহেবের সম্মান কমে যাবে। কিংকর্তব্যবিমুঢ় নাজিমুদ্দিন ভেবে পায় না।

জেবিন অতি চতুর তাই ঝুপুর ও মেহজাবিনকে সাথে নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা করল। চিঠিতে জানতে পেরে কোথায় ওদের উঠাবে এই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতে লাগল রাজন। ওরা একটু বেশী আধুনিক। ওরাতো এই মফস্বলে এসে থাকতে পারবে না। নাজমা শুনে বলল ওরা আমার এখানে থাকলে নাজমা খুশী হয়। কিন্তু তার আর দরকার হলো না। ওরা টেলিফোনে আন্তর্জাতিকমানের হোটেল রয়েলের রুম বুক করে ফেলেছে। ওরা যে কয়দিন খুলনায় থাকবে, সে কয়দিন হোটেল রয়েলেই থাকবে।

খুলনা থেকে বাগেরহাট বেশ দুর। রাজন পিসি কলেজে অধ্যাপনা করছে আর খুলনা কোর্টে এসে মাঝে মাঝে উকালাতির প্রাকটিস করছে। খুলনা থেকে বাগেরহাট এই মাঝে খরস্রোতা রূপসা নদী। যাহা বহু বিচ্ছেদের সাক্ষী। চাচা নাজিমউদ্দিন রাজনের উপর এ জন্য বৈরাগ। কারন তার কোন সন্তান নেই। ওরাই তিন ভাই বোনই সব। ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ পাস করে আসে সবাই। নিজে চেয়ারমানি করার জন্য নিজেদের স্বহায় সম্পত্তি সব কিছু দেখাশুনা করতে পারেন না। রাজন তাকে সাহায্য করলে উপকার হয়। তাতে রাজন কিনা একটা সরকারী কলেজের প্রভাষকের দায়িত্ব নিয়ে ৩৫০ কিলোমিটার দুরে চলে এসেছে। তারপর নাম পরিচয়হীন এক মেয়ের প্রেমে পড়েছে।

বাগেরহাটের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া সরনখোলা নদী। যে নদীতে সাগর থেকে ভেসে আসে এক বিরাট নীল তিমি মাছ। যার কংকাল নড়াইলের নিরিবিলি পিকনিক সেন্টারে সংরক্ষিত আছে। এই নদীর পাশে সারিসারি নারকেল আর সুপারির বাগিচা দেখে পছন্দ করে, একটা বাড়ী ক্রয় করবে রাজন। নিরিবিলি পরিবেশে মাঝে মাঝে বেড়াতে আসতে পারবে। কবি সাহিত্যেকের মত কিছু রচনা করিতে পারবে। যেহেতু বাগেরহাট শ্বশুর বাড়ী হবে, সেহেতু বাড়ীটা বিশেষ দরকার হবে।

পড়ার টেবিলে বসে তামান্না কেয়াকে পড়াচ্ছে। আজ কেমন তামান্নার মনটা ভাল না। রাজনের চিঠির ঠিকানা অনুযায়ি জেবিন ও ঝুপুর এল নামজার বাড়ী। দু’জনেরই প্যান্ট শার্ট ও কেড্স পরা, বিদেশী ষ্টাইল। জেবিন তামান্নাকে দেখে বুঝতে পারল এই তামান্না।
আপনার নাম তামান্না? রাজন কোথায়?
এই আচমকা প্রশ্নে তামান্না কোন উত্তর করতে পারল না। আর এদের পোশাক আশাক ও হাব ভাব দেখে ভাল লাগছে না। শুধু এটুকু বলল-রাজনকে আমি চিনি না। বলে নাজমার ঘরে চলে গেল। জেবিন কিছুটা অপমান বোধ করল, তামান্নার উঠে যাওয়াতে। জেবিন তামান্নার হাত ধরে বলছে-ঝুপুুর আমি এখানে আর এক মুহুর্ত বসব না। অসভ্য, বর্বর, অশিক্ষিত।
ঝুপুর বলছে-জেবিন, আমি এর শেষ না দেখে উঠছিনা। আমি এর শেষ দেখেই যাব। ঝুপুর কেয়াকে জিজ্ঞাস করছে তোমার নাম কি? কেয়া-কেয়া উত্তর করল?
তোমাদের এখানে রাজন আসে?
নাজমা ও তামান্না এল। নাজমা বলছে-হ্যা রাজন আসে, প্রতিদিন আসে। আজকেও হয়ত আসবে। ও খুলনায় গেছে তোমাদের হোটেলে। আপনি বলছেন রাজন প্রতিদিন আসে আর মিস তমা বলছে, রাজনকে চেনেই না। এই সব ফাজলামু আমাদের সাতে কেন হচ্ছে? দেখ মিস তমা, তুমি যেটা ভাবছ। সেটা কখনই সম্ভব হবে না।
তামান্না নিরব। তামান্নাকে আদর করে রাজন তমা বলে ডাকে। নাজমা বলছে-তোমরা এভাবে বলছ কেন? প্রতিত্তোরে জেবিন-আমরা এখানে ভদ্রতা শিখতে আসিনি। শেখাতেও আসিনি। এমন সময় মটর সাইকেল নিয়ে রাজন এসে হাজির। সবাই রাজনকে দেখে চুপ করে আছে। রাজন এসে নাজমার সাথে ওদের পরিচয় করে দিচ্ছে। এই জেবিন আমার বোন, আর এই হচ্ছে জেবিনের বন্ধু ঝুপুর। জেবিনবে বলছে, এই হচ্ছে তমা। যার সাথে আমার বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে। জেবিন, তোমার পছন্দ হয়েছে তমাকে।
রাজ পছন্দ করার আগে আমাদের সাথে কথা বলা উচিৎ ছিল তোমার। ঝুপুর, চল আমি এখানে আর একদম বসব না।
জেবিন, যাব। তবে রাজের সাথে একটা কথা না বলে উঠতে পারছি না। রাজনের কাছাকাছি গিয়ে-রাজ, আজ থেকে পাঁচ বছর আগে আলিগড়ে তোমার পরিয়ে দেওয়া আংটিটা আমার হাতের আঙ্গুলে অতি যতেœর সাথে রেখেছি। আমার সারা অস্থিত্বের সাথে মিশিয়ে রেখেছি। কখনো খুলে ফেলতে হবে ভাবিনি। আর এটা আমি নিজের হাতে খুলে ফেলতে পারব না। তোমার আংটি তুমি খুলে নাও রাজ। নাও খুলে নাও।

রাজন অনেক আগেই ঝুপুরকে অপছন্দ করা শুরু করেছে। দীর্ঘদিন ধরে ঝুপুরের সাথে যোগাযোগও বন্ধ রেখেছে। ঝুপুরের ওয়েস্টানি চাল চলন রাজনের এখন কম পছন্দ হয় । রাজন চায় একশো পার্চেন্ট বাঙ্গালী হতে। তাই ঝুপুরের হাতের আংটি খুলে নিল। জেবিন ও ঝুপুর রাগ করে চলে গেলে। তামান্না ঘটনাটা নিয়ে ভাবছে। কি ঘটনাটি ঘটল? এটা কি একটা নাটক, না অন্য কিছু। রাজন তামান্নার হাত ধরে বলছে-তমা, তুমি একটু বাইরে যাবে?
তামান্না না বলল না। দুজন বাইরে চলে গেল মটর সাইকেল নিয়ে। মটর সাইকেল নিয়ে ওরা নেবাল ক্যাম্পের ভিতর ঢুকে একেবারে নদীর পাশে নারকেল গাছের সারির মাঝে শুধু নারকের গাছ আর নারকেল গাছ। নদীর মাঝ দিয়ে মাঝে মাঝে দু একটা ট্রলার যাচ্ছে নিরব প্রকৃতি সেখানে রাজন মটর সাইকেল রেখে দুজন একটি হেলিয়ে থাকা নারকেল গাছে ভর দিয়ে দাড়িয়ে বলে চলছে-তমা, আমি যখন ভারতের আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, তখন একটা বাজী ধরার মত, আমি ঝুপুরকে প্রেমের ফান্দে ফেলি। আর এই আংটিটি ওর হাতে পরে দিই। দিনে দিনে ঝুপুর কেমন যেন হয়ে গেল। বাঙ্গালীওনা বলে ওর মাঝে কিছুই রইলো না। উচ্চবিলাসী ওয়েস্টার্ন কালচার ওকে আকড়ে ধরলো। রাতের পর রাত ও নাইট ক্লাবে গিয়ে আনন্দ ফুর্তি করতে থাকে। নেশার কোনটি ও বাদ দেই নি। সিগারেট গাঁজা মদ সব। আমার বাঁধা নিষেধ ও মানে নি। এ জন্য ওকে আমার আর ভাল লাগল না। তাই বিয়ে করি নি আমি। এই চাকরি পেয়ে আমি বাগেরহাট পিসি কলেজে চলে আসি। আর ঝুপুর রীতিমত আমাদের ফ্যামিলির সাতে ঐ একই হাল চালে চলছে। এখন বলছে সে আমাকে চায়।

তামান্না কোন দিন যা করেনি, আজ তাই করল। রাজনের কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। মুখের দিকে তাকিয়ে বুকের শার্টের ফাঁক দিয়ে লোমগুলো কয়েক বার হাত দিয়ে স্পর্শ করল, তার পর বলছে-প্রিয়, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি। খুব ভালবাসি। একদিন যে আংটি তুমি একজনকে পরিয়েছিলে আজ সে আংটি তুমি আমাকে দিয়ে খুলালে কেন? যে একদিন নিজেকে সম্পূর্ণ তোমার হাতে উৎসর্গ করেছিল, তাকে তুমি আপন করে রাখলেনা কেন? তোমার মুঠো আলগা হয়েছে বলে, দশের মুঠোর চাপ পড়েছে ওর উপর। ওর মুড গেছে বদলে। ওর হৃদয় গেছে মরে। প্রিয়, আমার একটি কথা রাখবে? বল কথা দাও রাখবে?
তোমার কথা আমি রাখবনা কেন? অবশ্যই রাখব। বল
ও এখান থেকে অনেক কষ্ট নিয়ে আজ চলে গেছে, তাকে একটু শান্তনা দিতে না পারলেও সঙ্গ দাওগে। একটা কথা তোমাকে বলি প্রিয়, আর কোন দিন বলব না। আমার সমস্ত ভালবাসা দিয়েই বলছি, আমাকে তুমি কোন স্মৃতি চিহ্ন দিও না। চিহ্ন রাখবার দরকার নেই। আমার প্রেম থাক নিরঞ্জন। বাইরের কোন রেখা, বাইরের কোন ছায়া, তাতে পড়বে না। বলে হাতের আংটিটি রাজনের হাতে দিয়ে দিল। সায়ন্থের এই পৃথিবী, যেমন অনন্ত অসিম, উদ্ভাসিত আকাশের দিকে নিঃশব্দে আপন আপন মুখ তুলে ধরছে। তেমনি নিরবে, তেমনি কামনার দিপ্তিতে, তামান্না আপন মুখ তুলে ধরছে, রাজনের মুখের দিকে। তারপর বিড়বিড় করে আবার বলছে
প্রিয়, তুমি ঝুপুরকে বিয়ে করলে সুখী হবে। পরিবারের সবাই খুশী হবে। আর আমাকে বিয়ে করলে পরিবারের সবাই বৈরাগ থাকবে। তুমি সুখী হতে পারবে না। আর আমার চেয়ে ঝুপুরই তোমার পাশে বেশী মানান। আমাকে ভুলতে বলব না, তবে বলব ঝুপুরকে গ্রহন কর। সূর্য তখন লাল হয়ে অস্থ যাচ্ছে। গোধুলির লালিমায় তমার মুখটা আরো বেশি লাল। আর চোখ দিয়ে কামনা বাসনার আমন্ত্রণ। ঠোট দিয়ে যেন লাল রক্ত ফুটে বেরিয়ে আসছে। রাজন তমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল অপলক দৃষ্টিতে। আর মনে মনে ভাবছে তমা তোমাকে সারাটা জীবন এভাবে দেখবো। তারপর সন্ধ্যা নেমে এলো দুজন নিজ নিজ ঠিকানার খোজে দুদিকে চলে গেল।

রাজন কয়েক দিন হল বোনদের সাথে রয়েছে। তামান্নার সাথে যোগাযোগ করে খুজে পাচ্ছেনা। বোনদের প্রচন্ড চাপের মুখে এবং ঝুপুরের হাত পা ধরা ও ঝুপুরের পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে রাজন রাজি হয় ঝুপুরকে বিয়ে করতে। ঐ ফাল্গুন মাসের ১৫ তারিখে বিবাহ হবে বলে দিন তারিখ ঠিক রইলো। শুধু কনের জায়গা কনের নাম পরিবর্তন হইলো।

সপ্তাহ খানেক এক সাথে শহরে ঘুরে ফিরছে। ঢাকায় চলে আসবে ওদিকে পিসি কলেজ থেকে বদলি হয়ে ঢাকার বাংলা কলেজে ট্রান্সফার হয়েছে। শেষ দেখা করতে গেল তামান্নার সাথে। কিন্তু নাজমার বাড়ীতে যেয়ে আর তামান্নার সাক্ষাত মিলল না। নাজমার কাছে শুনতে পায় কয়েক দিন ধরে তামান্না এ বাসায় আসছে না। তার কোন খোজ খবর কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না। রাজন মেহজাবিনকে সাথে নিয়ে রয়্যালের মোড় থেকে রিক্সা যোগে রূপসা ঘাটের দিকে যাচ্ছে। রিক্সা ওয়ালার মুখে শোনতে পেল রূপসা ফেরি ঘাটে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে। রাজন গেল লাশটা দেখতে। যেয়ে দেখে আর কারো লাশ নহে রাজনের প্রিয়তমার লাশ। ওরা যাবার সাথে সাথে পুলিশ ঘটনা স্থলে পৌছালো এবং তামান্নার লাশটিকে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে সদর হাসপাতালের মর্গে নিয়ে গেল পোষ্ট মর্টেম করার জন্য। পুলিশের ভ্যানের পিছ পিছ রিক্সা নিয়ে সদর হাসপাতালে গেল। মর্গে লাশের ডাক্তারী পরীক্ষা করে ডাক্তার বের হলে রাজন গিয়ে জিজ্ঞেস করছে। ডাক্তার সাহেব…..আর কিছু বলতে পারিনি। ডাক্তার জানায় বুকে ব্লাউজের ভিতরে পাওয়া গেছে এক খানা ভাজ করা কাগজ। এই দেখুন কি লেখা আছে। ভিজে গেছে পড়া যাচ্ছেনা। রাজন কাগজের টুকরাটি নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় রোদে গিয়ে রাখে। কিছুটা শুকালে দেখতে পায় লেখা আছে-
প্রিয়
তোমাকে ভুলতে পারলাম না। আর পারবও না। বেঁচে থেকে ধুকে ধুকে জ্বলে জ্বলে মরার চেয়ে একেবারে পানিতে ঠান্ডা হয়ে মরা শ্রেয়। আমি সুখী যদি তুমি সুখী থাকো। তুমিতো লেখা লেখি করো, এই বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে একখানা উপন্যাস লিখ। ইতি তোমার প্রিয়তমা।

রাজন মেহজাবিনের গায়ের উপর ভর করে রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছে বলছে- “তামান্না তোমার ভালবাসার কাছে আমি হার মেনে গেলাম। এই বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই কিছু লিখব। যদি কিছু রচনা করি তা তোমাকে নিয়েই করব।
অনেকদিন চলে গেল রাজন এবার লিখতে বসলো উপন্যাস লিখবে। এই ঘটনাকে সে কিভাবে লিখবে ভাবছে। সবাইতো অতীতকে অতীত বানিয়ে রাখতে চায়। ভারতের বিখ্যাত আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজন সেও ঠিক সবার দলে যোগ না দিয়ে ঘটনাটি নিয়ে সুখের স্মৃতিগুলোকে আকড়ে ধরে ১২০ পৃষ্টার উপন্যাস লিখে ফেলল। নামকরণ করলো ‘প্রিয়তমার উপহার’।

**********