Home

২০১২ সালের ৪ জুলাই, ঢাকার ফার্মগেটস্থ খামারবাড়ীর কৃষি তথ্য সার্ভিসের কনফারেন্স রুমে অনুষ্ঠিত হয় মোঃ বায়েজিদ মোড়লের ‘ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এন্ড এগ্রিকালচার ডেভেপোমন্টে’ এর ওপর পিএইচডি ডিগ্রি কোর্সের শেষ সেমিনার। তার গবেষনার বিষয় ছিল “বাংলাদেশ এগ্রিকালচার সেক্টর ডেভেলোপমেন্ট রোল অব ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া।” থিসিস সুপারভাইজার কমিটির প্রধান হচ্ছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. এম এ রহিম, মেম্বর অব সুপারভাইজারি কমিটিতে ছিলেন ইনস্টিটিউট অব রিসোর্স ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. রেজাউল আলম।

থিসিসি পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন-তত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক কৃষি

 

উপদেষ্টা ড. সি এস করিম।

কৃষি ক্ষেত্রে মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব ও চানেল আই এর বার্তা পরিচালক এবং হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের সফল উপস্থাপক ও পরিচালক জনাব শাইখ সিরাজ।

বিটিভির মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকী, কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববদ্যালয়ের শিক্ষক ড. হাবিবুর রহমান, ড. মোক্তার হোসেন, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এ এইচ এম সোলায়মান, তাজুল ইসলাম চৌধুরী, অন্যানদের মধ্যে পিকটোরিয়ালের সমির কে দত্ত, ফার্ম হাউজের খোরশেদ আলম, এটিএন বাংলার নবুয়াত রহমান, ফোয়াবের মোল্যা শামসুর রহমান শাহীন ও চ্যানেল আই এর সঞ্জয় তরফদার প্রমুখ উপস্থিত থেকে বায়েজিদ মোড়লের অভিসন্দর্ভ নিয়ে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা করেন। টানা তিন ঘন্টা ব্যাপি সেমিনারের থিসিস নিয়ে সবার প্রশ্নের উত্তর দেন সুপারভাইজার ড. এম এ রহিম।

 

ড. সি এস করিম বলেন-বায়েজিদের এই গবেষনা মিডিয়া ও কৃষি সেক্টরের সবার কাজে লাগবে। একটি মাইল ফলক কাজ করেছেন বায়েজিদ। শাইখ সিরাজ বলেন-যেটা তার করার কথা ছিল সেটা তিনি পারেন নি, তার শিষ্য করেছেন। নজরুল ইসলাম বলেন-আগে এ ধরনের কাজ ছিলনা এটাই বাংলাদেশে প্রথম কাজ।

রেজাউল করিম সিদ্দিকী বলেন-বায়েজিদ সব সময় সৃষ্টিশীল চিন্তা করে আমরা তার কর্মকান্ডের মধ্যে দেখেছি।

ড. রেজাউল আলম বলেন-বায়েজিদ তার গবেষনায় এতো জিনিস এনেছে, এতো বিষয়ে ডাটা এনালাইসিস করেছে যে,  অক্সফোর্ড টেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বায়েজিদের উপর খুবই খুশি হয়েছেন।

মোঃ বায়েজিদ মোড়ল।
মিডিয়াতে মোড়ল কামরুল হাসান বায়েজিদ নামে পরিচিত।

ড. এম এ রহিম ও ড. রেজাউল আলম

বায়েজিদ খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার লাখোহাটি গ্রামে ১০ জুন ১৯৭৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম বদিয়ার রহমান মোড়ল, মাতার নাম ফরিদা রহমান। তিনি গ্রামের স্কুলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশুনা শেষ করেন। পরে খুলনার ঐতিহ্যবাহী সরকারী ব্রজলাল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিন একই কলেজ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন।

২০০০ সালে একুশে টেলিভিশনে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু। তখন একুশে টেলিভিশনের গ্রামগঞ্জভিত্তিক অনুষ্ঠান ‘দেশজুড়ে, বেশ জনপ্রিয়তা পায়। এরপর ২০০৩ সালে তিনি চ্যানেল আই’তে যোগদান করেন। তিনি শাইখ সিরাজের হৃদয়ে মাটি ও মানুষ অনুষ্ঠানের একজন গবেষনাকর্মী হিসেবে কাজ করেন।

 

 ২০০৬ সালে বাংলাভিশনে যোগদান করে কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘শ্যামল বাংলা’ পরিচালনা শুরু করেন। তখন বাংলাভিশনেএই অনুষ্ঠানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। পাশাপাশী প্রফেসর ড. আতিউর রহমানের উপস্থাপনায় ‘নদী ও জীবন’ নামে আরো একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। এটিও অনেক জনপ্রিয় হয়। ২০০৯ সালে বৈশাখী টেলিভিশনে যোগদান করে ‘কৃষি ও জীবন, অনুষ্ঠানের পরিকল্পণা, তথ্য সংগ্রহ, গবেষনা ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি টেলিভিশন অনুষ্ঠান পরিচালনা করে খ্যাতি ও সুনাম অর্জন করেছেন। ‘শ্যামল বাংলা’ ও ‘কৃষি ও জীবন’ এবং সবুজ বাংলা অনুষ্ঠানের জন্য তিনি বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠান থেকে সম্মাননা সনদসহ ২১টি পদক ও ক্রেষ্ট পান।

ইতিমধ্যে বায়েজিদের লেখা উপন্যাস “ভালোবাসিনি তবে…” ও ছোট গল্পের বই “প্রিয়তমার উপহার” এবং কবিতার বই ‘ওরে বাধি কিছু গান কিছু কবিতায়’ নামে ৩টি বই প্রকাশিত হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি দৈনিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন জার্নালে কৃষি বিষয়ক গবেষনাধর্মী লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত। খুব শিগগিরই তার সংকলিত আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কৃষি ও কৃষির উপখাত নিয়ে কৃষি প্রযুক্তি সহায়ক হাতবই প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।

বর্তমানে মোড়ল কামরুল হাসান বায়েজিদ জিটিভিতে নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে কর্মরত আছেন। জিটিভিতে তিনি কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘সবুজ বাংলা’ ও স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘হ্যালো ডাক্তার’ প্রযোজনা করছেন। এছাড়া অনুষ্ঠান বিভাগের নির্বাহী প্রযোজক হিসেবে তাকে একটি বড় দায় দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে হয় জিটিভিতে। জিটিভি দেশের সকল মানুষের মন জয় করতে সক্ষম হয়েছে।

বায়েজিদ যখন কৃষি ও কৃষি উপখাতের তথ্য সংগ্রহ করতে বিভিন্ন অধিদপ্তরে যান। তখন কৃষি সেক্টরের অনেক কৃষিবিদ আছেন, যারা শাইখ সিরাজের কর্মকান্ড নিয়ে বিরুপ মন্তব্য করতেন। আর এই বিরুপ মন্তব্য করার পেছনে মুল কারন তারা দেখায়-শাইখ সিরাজ কৃষিবিদ না, তারা কৃষিবিদ। সত্যিকথা বলতে কি শাইখ সিরাজ কৃষিবিদ না তবে কি হয়েছে, তার সামনে কৃষি বিষয়ক তথ্য উপাত্ত নিয়ে কথা বলতে গেলে ১০ জন কৃষিবিদ একসাথে গিয়ে কথা বললেও শাইখ সিরাজকে হারাতে পারবে বলে মনে হয়না। শাইখ সিরাজ, রেজাউল করিম সিদ্দিকী ও বায়েজিদ মোড়ল কৃষি ও কৃষির উপখাতের এমন কোন বিষয় নেই যে কিছুটা হলেও জানা নেই। টেলিভিশনে কৃষি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে সব বিষয়ে কম বেশি জানতে হয়। কৃষি তথ্য গ্রামের নিরক্ষর কৃষকরাও জানেন তাদের সামনে ভাওতাবাজি, ধোকাবাজী করা যায় না। আর ধোকাবাজী করতে গেলে শাইখ সিরাজ, রেজাউল করিম সিদ্দিকী ও বায়েজিদ মোড়ল মিডিয়াতে কৃষি উন্নয়ন করতে পারতেন না। অনেক আগেই হারিয়ে যেতেন।

একটা জিনিস জোর গলায় বলতে চাই, কৃষি বিষয়ের বিভিন্ন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেন কৃষিবিদ আর কৃষি বিজ্ঞানীরা। কিন্তু সেই প্রযুক্তিটি খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দেশের সব মানুষের কাছে পৌছে দেন এই শাইখ সিরাজ, রেজাউল করিম সিদ্দিকী ও বায়েজিদ মোড়ল নামের মিডিয়া কর্মীরা। বায়েজিদ মোড়ল তার ওস্তাদ শাইখ সিরাজের কাছে শিখেছেন দেশের মানুষকে ভালবাসতে হলে, দেশের সত্যিকারের উন্নয়ন করতে গেলে, কৃষকদের উন্নয়ন করতে হবে। কৃষির উন্নয়ন করতে হবে। কৃষির উন্নয় ছাড়া দেশের উন্নয়ন হবেনা। পেটে ক্ষুদা থাকলে কোন কাজ করা যায়না। তাই ১৬ কোটি মানুষের পেটে ভাত তুলে দেয় যারা, তাদের নিয়ে কাজ করতে হবে। তাদেরকে সমৃদ্ধ করতে হবে। তারা সমৃদ্ধ হলেই দেশ সমৃদ্ধ হবে। আর এর জন্য সব চেয়ে বেশি ভুমিকা রাখতে পারে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া। এরকম একটা ভাবনা থেকে বায়েজিদ মোড়ল কৃষি ও টেলিভিশন মিডিয়া নিয়ে পিএইচডি করার জন্য দেশের বিভিন্ন পাবলিক ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ করেন। তখন ময়মনসিংস্থ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের হর্টিকালচার ডেপার্টমেন্টের প্রফেসর ড. এম এ রহিম, বায়েজিদ মোড়লের আগ্রহ ও ইচ্ছা দেখে তিনি সুপারভাইজার হয়ে অভিসন্দর্ভ তৈরীতে সুপারভাইজ দেওয়া শুরু করেন ২০০৮ সাল থেকে। এর পর বায়েজিদ মোড়ল আমেরিকার টেক্সাস রাজ্যের অক্সফোর্ড ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটিতে ঢাকাস্থ ইনস্টিটিউট অব রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এর সহযোগীতায় ২০০৯ সালে ভর্তি হোন।

বায়েজিদ মোড়ল তার এই পিএইচডি গবেষনার জন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে ৮ টি কাটাগরির প্রশ্ন পত্র তৈরী করেছিলেন। তিনি দেশের মোট ৫৯ জেলায় গিয়েছেন এবং ১০-১২ হাজার মানুষের সাথে কথা বলেছেন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে ৩৪টি জেলার মানুষকে দিয়ে তিনি সরাসরি প্রশ্ন পত্র সম্বলিত ফরম পূরণ করিয়েছেন। এখানে উপজেলা ছিল ৮৩টি। মোট প্রশ্নপত্র পূরণ করেছেন ৮১৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ৬১১ জন। মহিলা ২০৫ জন। গ্রামের হাল চাষ করা সরাসরী কৃষক ৫০৭জন, কৃষিবিদ ৫৭জন, টেলিভিশনে কৃষি অনুষ্ঠান নির্মান কর্মী ১৬ জন, কৃষি ব্যবসায়ী ৬০ জন, নার্সারীম্যান ও ফলের বাগানকারী ৭৫ জন, পোল্ট্রি-গাবাদী-মৎস্যচাষী ৮৫ জন ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ১৬ জন।

তার গবেষনায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষি উপখাতের অতীত ও বতর্মান সিনারিও। কৃষি ও কৃষি উপখাতের বিবর্তনের ইতিহাস। কৃষি তথ্য প্রযুক্তি ও কৃষি গবেষনা। এক কথায় বাংলাদেশে কৃষি ও কৃষি উপখাতের কোথায় কি হচ্ছে কোনটাই বাদ পড়েনি তার গবেষনা থেকে। আরো আছে টেলিভিশন, রেডিও, মোবাইল, ইন্টারনেট, ডিজিটাল প্রশিক্ষন, সংবাদপত্র সহ ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ার ইতিহাস উদ্ভব, বিকাশ ও বিবর্তন। বাংলাদেশের কৃষির উন্নয়নে কোন মিডিয়ার কি ভূমিকা আছে তা সুন্দর ও সাবলীল ভাবে এনালাইসিসসহ তুলে ধরেছেন। পাশাপাশী জনপ্রিয় বিষয়গুলিকে জোর দিয়েছেন বেশি। ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়াগুলোর মধ্যে কোন মাধ্যমটি কৃষকদের জন্য বেশি উপযোগি এবং গ্রহণযোগ্য সেটাই তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

বায়েজিদ মোড়লের গ্রামের বাড়ী খুলনা জেলার দিঘলিয়া উপজেলার লাখোহাটি গ্রামে। সকল নাগরিক সুবিধা বঞ্চিত এই লাখোহাটি গ্রামে থেকে হারিকেনের আলোতে তিনি অনার্সসহ মাস্টার্স পাস করেন ১৯৯৮ সালে। বায়েজিদ পিতা-মাতার ৬ সন্তানের মধ্যে জৈষ্ট। বায়েজিদের পিতার নাম বদিয়ার রহমান মোড়ল। তাকে নিরক্ষর বলা যাবেনা তিনি পড়তে পারেন, কিন্তু বানান করে করে। লিখতেও পারেন, লিখার মধ্যে শুধু নামটিই সই করতে পারেন। কিংবা অন্য কারো নাম লিখে দিতে পারেন। খাতায় একটি লাইন লিখতে গেলে লাইন এতোই বাঁকায় যায় যে পরের লাইনটি তিনি আর লেখেন না।

মাতা ফরিদা রহমান। পাশের যশোর জেলার সিদ্দিপাশা গ্রামের মেয়ে তিনি। হাইস্কুলে গিয়েছিলেন তারপর বিয়ে হয়ে যাওয়ায় আর পড়ালেখা করতে পারেননি। তার অদম্য ইচ্ছা ছিল বড় ছেলে বায়েজিদকে লেখা পড়া শেখানোর। বায়েজিদের যখন জন্ম হয় তখন ফরিদা-বদিয়ারের সংসারে এতোই অভাব ছিল যে, তিন বেলা মা ফরিদা পেট পুরে ভাত খেতে পেতনা। সকালে শাপলা ভাজি আর কিছু চাউল দিয়ে হয়তো আটার জাউ কিংবা আটার ডুটি পিটা, দুপুরে শাপলা ভাজি, ড্যাপের ভাত, আটার জাউ কিংবা আটার ডুটি পিটা। রাতে শাপলা ভাজি, ভাত আর রুটি আধাআধি। অভাব অনটনে জড়িত সংসারের প্রসুতিমা এমন খাবার খেলে সন্তান বায়েজিদও পেট ভরে দুধ পাইনি ক্ষেতে। এরপর হাটি হাটি পা পা করে বায়েজিদ বড় হতে থাকে। মুখে ফুটতে থাকে কথা। মা শিখাতে থাকে আদর্শলিপির ছড়া। অনেক ছোট বেলায় বইগুলো পড়ে মুখস্ত করে ফেলে বায়েজিদ। মা ফরিদা বায়েজিদকে লেখাপড়া শিখানোর জন্য ঘরে বসে অন্যের কাঁথা সেলাই করতেন কিছু উপার্জন হবে এই আশায়। মা ঘরে বসে কাঁথা সেলাই করতেন তার পাশে বসে বায়েজিদ বই পড়তেন। কিন্তু কাঁথা সেলাই করা সেই উপার্জন মা ফরিদা বায়েজিদের পড়াশুনার ব্যয় না করে অভাব অনটন জড়িত সংসারেই খরচ করে ফেলতন। এখানে মা ফরিদার সহায় হয়েছিল বায়েজিদের পড়াশুনা করতে অতিরিক্ত টাকা ব্যয় করে প্রাইভেট মাষ্টার দিতে হয়নি। লাখোহাটি গ্রামের প্রাইমারী ও হাইস্কুলের অনেক শিক্ষক বায়েজিদকে বিনা টাকায় পড়িয়ে দিয়েছে। এদের মধ্যে আছেন শেখ হাফিজুর রহমান ও গোলাম মোস্তফা এবং শরীফ মাহফুজুর রহমান।  বায়েজিদের শিক্ষকরা মনে করতেন সে লেখাপড়ায় ভাল করবে। কত ভাল করবে এটা জানতেন না। ক্লাসে সে শুধু ক্লাসের পড়াটা করতে পারতো। পরীক্ষার সময় খুব ভাল করতে পারিনি কখনোই। একজন ছাত্র হিসেবে বাড়তি তার ভিতর কোন কিছুই ছিল না। গোল্লাছুট ছাড়া আর কোন রকম খেলাধুলা সে পারতো না। খেলাধুলা করবে সে সময় কই তার ?

মেয়র আনিসুল হকের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহন

মা ফরিদা স্বপ্ন দেখতেন, বায়েজিদ লেখাপড়া শিখে বড় হবে। কিন্তু কি পর্যন্ত লেখাপড়া শিখবে সেটা সে জানতো না। লাখোহাটি গ্রামের চার পাশ দিয়ে বিল। এক বছর বিল শুকালে, ধান চাষাবাদ হতো, পরের বছর আর বিল শুকাতো না, ধান চাষাবাদ হতোনা। ওদের এক ফসলি ধানি জমি ছিল মাত্র কয়েক শতাংশ। বায়েজিদ ছোট বেলায় তিনবেলা পেটপুরে খেতে পায়নি। আটার জাউ, ড্যাপের ভাত বা শাপলা ফলের ভাত, আটার ডুটি পিঠা বা আটা লবন দিয়ে সিদ্ধ, এগুলোই শাপলা ভাজি, কলমী শাক ভাজি, মালঞ্চ শাক ভাজি দিয়ে খেতে হতো।

ড. সিএস করিমের কাছ থেকে আশির্বাদ গ্রহন

শাপলা দিয়ে রান্না বিলের মাছের ঝোলও খেত। ওর মা একটা শাড়ী পরতো। গোসল করে শাড়ী ওঠানের রোদে নেড়ে দিয়ে ঘরের মধ্যে শায়হা (পেটিকোট) পরে বসে থাকতেন। শাড়ীটি শুকায় গেলে ঐ শাড়ীটি পরে বের হতেন। ওর বয়স যখন ৪-৫, তখন থেকেই তার দাদা আর বাবার সাথে বিলে গিয়ে কৃষি কাজ করা শুরু হয়। ওর দাদা বিলে গিয়ে হাল চাষ করতো, বিলে তিল ক্ষেত, আর ধান ক্ষেতে নিড়ানী দিত। ও দাদার জন্য সকালের নাস্তা নিয়ে বিলে যেত, দাদার সাথে সাথে কাজ করতো। ছোট একটা ছেলেকে কাজ করতে দেখে অনেকেই ওর দাদা মৃৎ কেরামত মোড়লকে জিজ্ঞেস করতো “এতো ছোট ছেলেকে কেন বিলে নিয়ে এসেছো কাজ করতে?” দাদা কোন উত্তর দিত না। বলতো “আমার পোতার জন্য দোয়া কইরো ভাই, ওর যেন ভাল লেখা পড়া হয়।”

 

বায়েজিদ স্কুলে যেত নিয়োমিত। ঝড় বৃষ্টি কোন ওজরে ও ক্লাস বাদ দিতনা। ওর দাদা মাঝে মাঝে স্কুলে গিয়ে শিক্ষকদের সাথে দেখা করে কথা বলতেন ‘বায়েজিদের যেন ভাল লেখাপড়া হয়।’ তেমনি ওর নানা মৃত শমতুল্লহ শেখও বলতো বায়েজিদের ভালো লেখাপড়া হবে। ওর দাদী তোতা বিবি প্রতিদিন রাতে এশার নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে বায়েজিদের জন্য দোয়া করতেন। নানা আগে পরে ওর দাদা যখন মারা যায় ও তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। দাদা মরার পর সংসারের অনেক কিছুর দায় ভার ওর ওপর এসে পড়ে। তখন ভাইবোন ৬ জন মিলে সংসারে ৯ জন মানুষ। সবার পেট চালাতেই হিমসীম খেত ওর পিতা। ভাল কাপড় চোপড় পাবে কোথায়? তাইতো শীত নিবারনের গায়ের চাদর পরেও বায়েজিদ চলা ফেরা করতো। ওর পরীক্ষার দিন সকালেও কোন না কোন কাজ করতে হতো। তেমনি পরীক্ষা দিয়ে বাড়ীতে ফিরে আবার কোন না কোন কাজ করতে হতো। তিন ঘন্টা একটানা লেখাপড়া ও করতে পারিনি কখনো। পরের জমিতে শ্রমিক হিসেবে শ্রম দিয়েছে ও।পৌষের শীতে বিলের ধান কাটার পর সেই ধান ক্ষেতের নাড়া বনে বড়শী পেতে মাছ ধরেছে ও। শীতের ঐ পানিতে পা দেওয়া যায় না, হাত দেওয়া যায় না। যেখানে ঐ পানি লাগে সেখানেই অবজ হয়ে যায়। শীত রোদ বৃষ্টি ঝড় কোনটাতেই ও থেমে থাকিনি।

বাড়িতে হাল চাষের জন্য ২টি দেশীয় জাতের গাভী ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠে গাভীকে খাওয়ানো, ঘাস না থাকলে বিলে যেত ঘাস কাটতে। বাড়ীতে কয়েকটি হাঁস পালতো এই হাঁসগুলোর জন্য একদিন পর একদিন শামুক কুড়াতে যেতে হতো। সেটা স্কুলের যাওয়ার আগে নয়তো স্কুল থেকে ফিরে গোসল করার আগে। দুপুরে খাওয়ার পর গাভী দুটিকে নিয়ে যেতে হতো বিলে চরায় ঘাস খাওয়াতে। ওর সমবয়সী ও কিছু বেশি বয়সের কয়েকজন রাখাল বন্ধু ছিল। ওর সেই রাখাল বন্ধুরা এখন কেউ অন্যের বাড়ী রাখাল হিসেবে আছে, আর কেউবা নিজে গেরহস্থ হয়েছে। যারা অনেকে ওকে খুব আদর করতো। সন্ধ্যায় গাভী দুটিকে নিয়ে বাড়ী ফেরার সময় গাভীর মুখে ঠুসি পরিয়ে দিত। অনেক দিনই ঘটেছে এমন ঘটনা, যে গাভীর মুখে যখন ও ঠুসি পরাতে যেত, তখন গাভী শিং নেড়ে এসে গুতা মারতো তাকে। একদিনতো গুতা মেরে ছুড়ে ফেলে দিল। অনেক ব্যাথা পেয়েছিল। সারা বিকাল ধরে কেঁদেছিল। একদিন খালের পাশ দিয়ে গাভী দুটিকে নিয়ে যাবার সময়, একটি গাভী খাল পার হতে গিয়ে পিছনের একটি পা ভেঙ্গে ফেলে। হত দরিদ্র সংসারে অর্থনৈতিক একটা ধাক্কা লাগে।

শীত গ্রীষ্ম আর বর্ষার কাঁদা মাটি আর পানিতে ওর হাত ও পায়ে ঘাঁ হয়ে যেত। পায়ের আঙ্গুলের মাঝে ঘাঁ হতো রাতে ঘুমাতে পারতোনা যন্ত্রনায়। মাঝে মাঝে পায়ের ঘায়ে তুঁতে লাগাতো। তখন ঘায়ের ওপর তুঁতে এমন কামড় মারতো যে যন্ত্রনায় ছটপট করতো চিৎকার করে কাঁদতো। আবার এতো অল্প বয়সে এতো কাজ করতে হতো বলে ঘাস কাটতে গিয়ে প্রায়শই হাত কেটে ফেলতো। এভাবে সারাদিন যাবার পর সন্ধ্যা বেলা গাভীদের খড় কুটা কেটে ও গোয়াল ঘরে মশা তাড়ানোর ঘষি-সাজাল ধোয়া দিয়ে তারপর হাত মুখ ধুয়ে বই নিয়ে বসতো পড়তে। কখনো কেরসিনের হারিকেনের আলোয় কখনো বা কেরসিনের ল্যাম্প বা কুপির আলোয়। এশার আযান দেবার পর লেখা পড়া শেষ, যেত খেতে তারপর ঘুম। সারাদিন প্রচুর কাটাখাটনির পর সন্ধ্যার সাথে সাথে তার দু চোখ জুড়ে আসতো ঘুম। পরীক্ষার আগে তাইতো মধ্যরাতে ওঠে বই পড়তো ও কখনো কেরসিন না থাকলে ওঠানে বসে চাঁদের আলো বা জোছনায় বা চাঁদনিতে লেখাপড়া করেছে। তার মনে ছিল লেখাপড়ার প্রতি প্রচন্ড ইচ্ছা। আর দীঢ় মনোবলের কারনেই বায়েজিদ ডক্টর অব ফিলোসপি (পিএইচডি) ডিগ্রি লাভ করলেন। ড. মোঃ বায়েজিদ মোড়ল আপনাদের দোয়া প্রার্থি।

তাসনিম

২০০৫ সালে খুলনার দিঘলিয়া গ্রামের কন্ঠশিল্পী শেখ আবুল বাশারের কন্যা মনিমালার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের এক কন্যা সন্তান মোবাশশিরা তাসনিম সোরিয়া ও এক পুত্র মোড়ল আরহাম তাহমিদ