ডেস্ক রিপোর্ট : কাউপি বা ফেলন একটি ডালের নাম। বাংলাদেশের অনেকেই হয়তো এই ডালটিকে চেনেন না, এমন কি এই ডালের নামও শোনেন নি। কথিত আছে – বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দূর্যোগের পরপরই উপদ্রত এলাকায় বিমান থেকে কাউপি ডালের প্যাকেট বা বস্তা ফেলা হয়েছিল বলে এই ডালের নাম হয়েছে ফেলন ডাল। কোন কোন এলাকায় এই ডাল বিমান থেকে ফেলা হয়ে ছিল বলে এই ডালকে প্লেন ডালও বলে।
পাঁচশত থেকে দুই হাজার বছর আগে আফ্রিকা থেকে ভারত উপমহাদেশে এই ডালের বিস্তার ঘটে বলে জানা যায়। বাংলাদেশের সমুদ্র উপক‚ল অঞ্চলে বিশেষ করে পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, নোয়াখালীসহ বেশ কিছু এলাকায় এই ডালের চাষাবাদ হয়ে থাকে। এই সমস্ত এলাকায় ফেলন ডাল বেশ পরিচিত এবং জনপ্রিয়। উপক‚লের অনেক কৃষক পরিবার এই ডাল নিয়মিত খেয়ে থাকেন।
আমাদের দেশে বিশেষ করে উপক‚লীয় অঞ্চলের একটি বিরাট জনগোষ্ঠী পুষ্টিহীনতায় ভোগে। কাউপি বা ফেলন ডালে ২৩-৩৫ ভাগ প্রোটিন এবং ৫৪-৫৮ ভাগ কার্বোহাইড্রেট থাকে। তাই এই ডাল গরীব পরিবারে পুষ্টি যোগাতে অত্যন্ত ইতিবাচক ভ‚মিকা রাখতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট কাউপি বা ফেলন ডালের পুষ্টিমান, কৃষক পরিবারে এই ডালের গ্রহনযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা এবং প্রতিকূল পরিবেশে এর উৎপাদন ক্ষমতা দেখে এই ডালের উন্নয়নে গবেষনা কার্যক্রম হাতে নেয়। প্রতিষ্ঠানটিএর মধ্যে ফেলন-১ নামে একটি উন্নত ফেলন ডালের জাত বের করতে সক্ষম হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সমূদ্র উপক‚লীয় অঞ্চলের কৃষি জমিতে ক্রমবর্ধমান লবনাক্ততা এবং জলাবদ্ধতার কারণে কৃষক এখন শুষ্ক মৌসুমে কাঙ্খিত মানের ফসল ফলাতে পারছে না। সে কারণে ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে আমন ধান কাটার পর পুরো শুস্ক মৌসুমে হাজার হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকছে।
আমন ধান কাটার পর শুষ্ক মৌসুমে এই সমস্ত পতিত জমিতে লাভজনক ফসল ফলানোর লক্ষ্যে কৃষক অনায়াসে কাউপি বা ফেলন ডাল চাষ করে ভাল ফলন ঘরে তুলতে পারে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপক‚লের কৃষি জমিতে গত দুই বছরে অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের যৌথ গবেষনায় জানা যায়, কাউপি বা ফেলন ডাল ফসল মধ্যম মাত্রার লবনাক্ততা সহিষ্ণু। অন্যান্য ডাল ফসল যেখানে অপেক্ষাকৃত কম লবনাক্ত জমিতেও ভাল ফলন দিতে পারছেনা, সেখানে কাউপি বা ফেলন ডাল মধ্যম মাত্রার লবনাক্ততা সহ্য করে ভাল ফলন দিতে সক্ষম।
এই ফসল খরা সহিষ্ণু। অন্যান্য ডাল ফসলের তুলনায় ফেলন গাছের শিকড় মাটির গভীরে যেতে পারে। তাই খরায় এই গাছ বেঁচে থাকতে পারে এবং কাংখিত ফলনও দিতে পারে।
ফেলন ডাল গাছ কিছুটা ঝোঁপালো। সে জন্য সূর্যের তাপ সরাসরি ফেলন ফসলের জমিতে পড়তে পারেনা। এ কারনে ফেলন ফসলের জমিতে বেশী দিন আদ্রতা থাকে, যা ভাল ফলনের জন্য সহায়ক।এছাড়াও ফেলন ফসল ঝোঁপালো হওয়ার কারণে জমিতে আগাছার পরিমাণও কম হয়। আগাছা কম হওয়ার কারণে পোকা-মাকড়ের উপদ্রবও অন্যান্য ডাল ফসলের তুলনায় কম। তাই তুলনা মূলক ভাবে বেশী ফলন পাওয়া যায়।
ফেলন শুধু ডাল নয়, একে সব্জী হিসেবেও খাওয়া হয়। উপকূলের কৃষক পরিবার সবুজ অবস্থায় ফেলন ছেইকে বরবটীর ন্যায় ভাজি করে খেয়ে থাকে, যা অত্যন্তপুষ্টি সমৃদ্ধ।
পরিপক্ক ছেই তুলে নেয়ার পরও ফেলন গাছ সবুজ থাকে, যা গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ফেলন গাছের শিকড়ে প্রচুর নডুউল উৎপন্নহয়, যা জমিকে উর্বর করে। তাই, কাউপি বা ফেলন শুধু মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা দেয় না, গবাদি পশু এবং জমির পুষ্টিও নিশ্চিত করে।
শুস্ক মৌসুমে সমুদ্র উপক‚লের লবনাক্ত পতিত জমিতে ফেলন ডাল চাষাবাদে এতগুলো সম্ভাবনার প্রেক্ষিতে এবং কৃষক পরিবারে এর জনপ্রিয়তা ও বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকায় অস্ট্রেলিয়া এবং বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা গত দুই বছর ধরে এই ডালের উন্নয়নে গবেষণা করছেন। এই গবেষণা কার্যক্রমে অস্ট্রেলিয়ার অঈওঅজ (অঁংঃৎধষরধহ ঈবহঃৎব ভড়ৎ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অমৎরপঁষঃঁৎব জবংবধৎপয) এবং বাংলাদেশের কএঋ (কৎরংযর এড়নবংযড়হধ ঋড়ঁহফধঃরড়হ) অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ কৃষিবিশ^বিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েষ্টার্ণ অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঈঝওজঙ এবং এগ্রেরিয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশন এই গবেষণা কার্যক্রমে সরাসরি সম্পৃক্ত।
প্রকল্পের আওতায় গত দুই বছর ধরে ওওঞঅ সহ পৃথিবীর বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগীতায় ৩৪৫টি কাউপি বা ফেলন ডালের জাত বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের বরিশাল রহমতপুর গবেষণার মাঠে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এই জাতগুলোর মধ্যে কয়েকটিজাত খরা ও তাপ সহিষ্ণু বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। কয়েকটি জাত অপেক্ষাকৃত বেশী লবনাক্ততা সহিষ্ণু বলে ধারনা করা হচ্ছে। কয়েকটি জাতকে কম জীবনকাল সমৃদ্ধ দেখা যাচ্ছে। আবার কয়েকটি জাতকে উচ্চ ফলনশীল হিসেবে প্রাথমিক ভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে এর মধ্য থেকে খুব সহসাই হয়তো ২-৩টি জাতকে প্রতিক‚লতা সহিষ্ণু উচ্চ ফলনশীল ফেলন ডালের জাত হিসেবে বাংলাদেশে চাষাবাদের জন্য উদ্ভাবন করা সম্ভব বলে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা আশাবাদী।
শুধু উন্নত জাত উদ্ভাবন নয়, এই প্রকল্প কৃষি যান্ত্রিকীকরণ নিয়েও গবেষণা করছে। প্রায় পাঁচশত বিঘা কৃষকের জমিতে পাঁচশতজন কৃষকের অংশ গ্রহনে বারি সিডার মেশিন দিয়ে ফেলন ও মুগ ডাল চাষাবাদের উপর গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। প্রচলিত পদ্ধতিতে ফেলন বা মুগ ডালের চাষাবাদের জন্য ১ বিঘা জমি তৈরী করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। এতে প্রায় দুই হাজার টাকা খরচ হয়। কিন্তু সিডার মেশিন দিয়ে মাত্র ১ ঘন্টায় ১ বিঘা জমিতে অনায়াসে একই সাথে জমি চাষ, লাইনে বীজ বোনা এবং সাথে সাথে বীজ ঢেকে দেয়া হচ্ছে। এতে খরচ হচ্ছে মাত্র ৪০০-৫০০ টাকা।
লাইনে বীজ বোনার কারণে আগাছা পরিস্কার করতে সুবিধা হচ্ছে। মেশিনের সাহায্যে বীজ সমভাবে মাটির নীচে বপন হওয়ার কারণে বীজ গঁজানোর হার অনেক বেশি হচ্ছে। একই সাথে সব বীজ গজাচ্ছে এবং পর্যাপ্ত আলো-বাতাস পেয়ে স্বাস্থ্যবান ডাল ফসল বেড়ে উঠছে। কৃষক এবং কৃষি বিজ্ঞানীদের অংশগ্রহন মূলক এই গবেষণায় কৃষক জানিয়েছেন, শুধুমাত্র সিডার মেশিন দিয়ে ডাল চাষ করলে দ্বিগুণেরও বেশী ফলন ঘরে আসছে। এ বছর শুধু পটুয়াখালীতেই কৃষকরা ৯০ হাজার হেক্টর জমিতে মুগডাল এবং ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ফেলন ডাল চাষ করে ছিল, যার অধিকাংশ জমিই পূর্বে পতিত ছিল।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয় এবং এগ্রেরিয়ান রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তথ্য উপাত্তে দেখা যায়- মুগ ও ফেলন ডাল চাষাবাদে কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ সবাই সরাসরি জড়িত। পুরুষ সদস্যরা জমি চাষও নিড়ানী কাজে জড়িত থাকলেও মহিলারা মুগ ও ফেলন ডালের ছেই তোলা থেকে শুরু করে ছেই রোদে শুকানো, মাড়াই করা, পরিস্কার করা, কালাই রোদে দেয়া, ঘরে সংরক্ষন করাসহ সব কাজ করে থাকেন।
এখন পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে ধান-গম ভাঙ্গানোর মত ডাল ভাঙ্গানোর মেশিন নাই। সে কারণে ডালচাষীরা কম মূল্যে মুগ বা ফেলন কালাই ফড়িয়াদের কাছে বিক্রী করে দিতে বাধ্য হয়। যেহেতু গ্রামে ডাল ভাঙ্গানোর মেশিন নাই, সেহেত ুপরিবারে ডাল খাওয়ার পরিমাণও অনেক কম। ডাল রান্না করে খাওয়ার জন্য শুকনো পরিস্কার কালাই বাড়ীর মহিলা সদস্যরা পাঁটা-পুতা বা জাঁতাতে ভেঙ্গে ক‚লায় পরিস্কার করে রান্নার উপযোগী করে নেয়। পুরো প্রক্রিয়াটি কষ্টকর এবং সময় সাপেক্ষ। এসব কারণে কৃষক ডাল উৎপাদন করলেও পরিবারে ডাল খাওয়ার পরিমাণ অনেক কম।
এই সমস্যা উত্তোরনে প্রকল্প থেকে গ্রামে ২-৩টি ছোট ডাল ভাঙ্গানোর মেশিন স্থাপন করে গবেষণা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করার কথা চিন্তা করা হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, ডাল ভাঙ্গানোর যান্ত্রিক প্রযুক্তি মিনি-মিল অঈওঅজএর পূর্বের প্রকল্পে উদ্ভাবন করা হয়েছে। এই মিনি-মিল দিয়ে একটি কৃষক পরিবার প্রতিদিন ১-৩টন পর্যন্ত ডাল সহজেই ভাঙ্গাতে পারবে। আমরা আশা করি, ডাল ভাঙ্গানোর এ ধরনের মিনি-মিল গ্রামে স্থাপন করলে কৃষক ডাল উৎপাদনের পাশা পাশি ডালের ভাল বাজার মূল্য পাবে এবং পরিবারে ডাল খাওয়ার পরিমাণ বাড়বে।
আমরা বিশ^াস করি, এই প্রকল্পে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিগুলো উপক‚লীয় অঞ্চলের দরিদ্র কৃষক পরিবারের স্বার্থে বাংলাদেশ সরকার তাদের নিজস্ব কার্যক্রমে অন্তর্ভূক্ত করবে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে উপক‚ল অঞ্চলে সম্প্রসারণ করে গরীব কৃষক পরিবারের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এবং তাদের খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তায় অবদান রাখবে। এক্ষেত্রে অঈওঅজ এবং কএঋ তাদের কারিগরি সহায়তার হাত বাড়াতে পারে।
ড. এম, জি, নিয়োগী
ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার
ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ণ অস্ট্রেলিয়া